সময় চলে। চলে। মিনিট। ঘন্টা। দিন। মাস। বছর। এভাবেই চলে আসছে সময়ের পরিক্রমা। সময় আসলে সময়েরই গহ্বরে মুখ লুকায়। পুরনো সময় গিয়ে আসে নূতন সময়। সময়ের সাথে সবই বদলায়। ফিরে আসে নূতন সাজে। ভিন্ন রূপে।
আর, সময়ের অমোঘ চক্করে পড়ে হারিয়ে যায় সময়ের সেরা সৃষ্টি- মানুষও। মৃত্যু কেড়ে মানুষের জীবন। মানুষের বিকল্প অন্য একজন মানুষ হতে পারে না কখনোই। তাই হারিয়ে যাওয়া মানুষটি শুধু স্মৃতি হয়েই বেঁচে থাকে প্রিয়জনদের কাছে। স্বজনদের কাছে।
মাকে হারিয়েছি কিশোরবেলায়। মায়ের স্মৃতি এখনো কাঁদায়। মা চলে যাবার পর, বাবা ছায়া হয়ে ছিলেন মাথার ওপর। আমাকে কাঁদিয়ে বাবাও চলে গেলেন ২০১৫এর অক্টোবরে।
বাবাকে ঘিরে অমিয় স্মৃতিকণাঃ
বাবাকে ঘিরে স্মৃতির শেষ নেই। উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না কিন্তু অনেক পড়াশোনা করতেন আমার বাবা। অনেকদিন গ্রামের মাদ্রাসায় শিক্ষকতাও করেছেন। কোরআনের তাফসির, হাদিসের ব্যাখ্যা যেমন জানতেন, তেমনি মুখস্ত ছিলো অসংখ্য বচন/প্রবচন-শ্লোক। গ্রামের মানুষ সে সময় পঞ্জিকা দেখতে চলে আসতো বাবার কাছে। ডাক্তার তখন গ্রামে ছিলো দুর্লভ। প্রায়ই দেখতাম সকালে পাড়ার কিছু লোক বাড়িতে এসে হাজির। উদ্দেশ্য – ইঞ্জেকশন দেয়া। বাবা ডাক্তারের নির্দেশনা মতো ইঞ্জেকশন দিয়ে দিতেন গ্রামের লোকজনদের।
কয়েকটি স্মৃতিকণা ঝলঝল করছে মানের কোণেঃ
একঃ ~~~
স্কুল থেকে ফিরে দেখি- সুন্দর ঘুড়িটা উড়ছে। নাটাইটা বাড়ির সামনে আকন্দ গাছে বাঁধা। লম্বা লেজের ঘুড়িটা দেখে মনটা ভরে যায়। ঘুড়িটা আমার জন্য বানিয়েছিলেন আমার বাবা। আমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য স্কুল থেকে ফেরার আগেই তা উড়িয়ে রেখেছে।
দুইঃ
~~~
তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলের মাঠ ভেসে গেছে পানিতে। বৃষ্টি থামার নাম নেই।
দিনের বেলায় নেমে এসেছে আঁধার। টিনশেড স্কুলে আটকা পড়ে আছি। দেখি- বাবা হাজির স্কুলে ছাতা নিয়ে। বাবার
হাত ধরে বাড়ি ফেরা - কতোই না সুখের।
তিনঃ
~~~
বইয়ের মলাটগুলো সুন্দর করে করে দিতেন বাবা। আর সুন্দর স্টাইল করে ক্লাস-রুটিনও লিখে দিতেন তিনি।
চারঃ
রাতে শুয়ে বাবা জানতে চাইলেন, স্কুলে আজ কী পড়িয়েছে। একপর্যায়ে বলেছিলাম- মাটির প্রকারভেদ। মাটি প্রকারগুলোর কথা জানতে চাইলে, আমি ভুল করে বলেছিলামঃ এলেট মাটি। বাবা বললেন, এটা এঁটেল মাটি হবে, এই নিয়ে তর্ক। তার আবার হারিকেন জ্বালিয়ে বই বের করা। আহা!!
পাচঃ
কোনো ভুল বা অন্যায় করলে মা সব সময় বাবার ভয় দেখাতেন। বলতেন, আসুক তোর বাবা আজ বাড়ি আসুক। বাবা বাড়ি এলে, মা অভিযোগ করতেন আবার নিজেই বলতেন, দৌড়ে পালা। মারবে তো।
বাবা আসলে কখনোই মারতেন না।
ছয়ঃ
বাবা প্রায়ই বলেতেন, আমাকে দেখলে তাঁর বাবার (মানে আমার দাদার) কথা মনে পড়ে। আমার নাক আর পিঠ নাকি দাদার মতো। পেছন থেকে আমাকে দেখলে আমাকে নাকি দাদার মতো লাগে। আমার নাক অনেক উঁচু বলে আমার নাক শিং মাছের নাকের মতো বলে খেপাতেন আমাকে।
বাবার চলে যাওয়াঃ
২০১৫এর অক্টোবরের ৩ তারিখ। বাড়ি তেকে জরুরি ফোন পেয়ে বাড়ি গেলাম। বাবা আমাকে দেখে কাঁদলেন। সন্ধ্যায় বাবার বিছানায় বাবার পাশে বসে আমি বাবার হাত ধরে আছি। দেখলাম বাবার চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। বাবা যেনো বিড়বিড় করে কী বললেন।
চলে যাবার মুহূর্তে আমি বাবার হাত ধরে ছিলাম। বাবাও শক্ত করে ধরে ছিলেন আমার হাত। এভাবেই চলে গেলেন। আমি যে কতো একা হয়ে গেলাম- কতোখানি- তা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না জানি।
আমি ছিলাম বাবার পরান!
বাবার আদর, বাবার স্নেহ একটু ব্যতিক্রম ছিলো
বাবা কেবল শাসন করেন এমন একটা ভ্রম ছিলো
কিন্তু বাবার ভালোবাসা
ছিলো গভীর, নয়তো ভাসা
প্রাণটা ছিলো আমার তরে, প্রকাশটাই যা কম ছিলো।
বাবা। আহা বাবা। আমার বাবা কৃষক ছিলো। কিন্তু আমি যেনো রাজপুত্তুরই ছিলাম।
~~~
ছবিতেঃ বাম থেকে বাবা, মাঝে আমি ও ডানে ছোট কাকু। জুলাই ২০১৫ তে তোলা।